সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

পলাশীর মর্মান্তিক ট্রাজেডি এবং আমদের শিক্ষা

কোন জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য না থাকা যেমন দুঃখজনক, তেমনি ইতিহাস থাকার পরও যে জাতি আপন ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞ সে জাতি নিঃসন্দেহে হতভাগ্য। কেননা ইতিহাস শুধু অতীতের ফেলে আসা হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার ঘটনাই প্রকাশ করে না; সাথে সাথে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ চলার পথের প্রেরণার উৎস ও সঠিক দিশা দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস যেমন দীর্ঘ তেমনি গৌরবময়। অথচ বাঙালী মুসলমানরা আজ তাদের সে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বেমালুম ভুলতে বসেছে।


ভারতবর্ষের বিচিত্র ইতিহাসের মধ্যে পলাশীর মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন মীর জাফর আর জগৎশেঠদের মত এদেশীয় কিছু ক্ষমতালিপ্সু স্বার্থান্বেষী বিশ্বাসঘাতকের চরম বিশ্বাসঘাতকতায় সুচতুর বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। সাথে সাথে এদেশের আকাশে নেমে আসে দুর্যোগের ঘনঘটা; বাংলার জমিনে নেমে আসে দুর্ভেদ্য অমানিশা; এদেশের মানুষের উপর চেপে বসে পরাধীনতার জগদ্দল পাথর। সেই থেকে সমগ্র ভারতবর্ষ ১৯০ বছর ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল। তাই প্রতি বছর জুন মাস আসলেই এদেশের স্বাধীনচেতা মানুষের অন্তরে জেগে উঠে পলাশীর আম্রকাননের বিভীষিকা। দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, শুরু থেকেই ভারতবর্ষের মুসলমানদের হেয় করার লক্ষ্যে এবং বাঙালী মুসলমান নেতাদের নামে কালিমা লেপনের উদ্দেশ্যে সুস্থ মস্তিষ্কে পলাশীর প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে সে চাপাপড়া ইতিহাস অনেকাংশে স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাই নতুন প্রজন্মকে প্রকৃতপক্ষে ইতিহাস সচেতন করে গড়ে তোলার লক্ষ্যেই আলোচ্য নিবন্ধে ঐতিহাসিক পলাশীর ট্র্যাজেডি সংক্ষিপ্তাকারে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে।


বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব ছিলেন আলীবর্দী খাঁ (১৭৪০-১৭৫৬)। তাঁর প্রকৃত নাম মীর্জা বন্দি বা মীর্জা মুহাম্মাদ আলী। তাঁর বড় ভাইয়ের নাম হাজী আহমাদ। তাঁদের পিতামহ ছিলেন আরব বংশোদ্ভূত, আর মাতা ছিলেন আফগান-তুর্কি বংশোদ্ভূত। সেই সুবাদে তাঁরা ছিলেন সুজাউদ্দীন খাঁর আত্মীয়। সুজাউদ্দীন ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর জামাতা। শ্বশুরের মৃত্যুর পর তিনি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাবী লাভ করেন। এদিকে ১৭০৭ সালে সংঘটিত জজুর যুদ্ধে যুবরাজ আজম শাহ নিহত হ’লে মীর্জা মুহাম্মাদ আলী ও বড় ভাই হাজি আহমাদ নিরুপায় হয়ে আত্মীয় সুজাউদ্দীন খাঁর দরবারে আসেন। সুজাউদ্দীন খাঁ তাঁদের দুই ভাইকে সরকারী চাকরীতে নিযুক্ত করেন। দুই ভাই সরকারী চাকরী পেয়ে অত্যন্ত দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে রাজকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। তাদের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে সুজাউদ্দীন খাঁ মীর্জা মুহম্মদকে রাজমহলের ফৌজদার নিযুক্ত করেন। তখন থেকে মীর্জা মুহম্মদ আলী ‘আলীবর্দী খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত হন। এরই ধারাবাহিকতায় এক পর্যায় আলীবর্দী খাঁ বিহারের সহকারী শাসনকর্তা নিযুক্ত হন (১৭৩৩)। সুজাউদ্দীন খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সরফরাজ খাঁ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন মারাঠা ও বর্গীদের লুণ্ঠন দমনের জন্য গভর্ণর আলীবর্দী খাঁ নবাবের অনুমতি প্রার্থনা করলে নবাব সেক্ষেত্রে গুরুত্ব না দেওয়ায় বীর আলীবর্দী খাঁ নবাব সরফরাজ খাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নবাবকে পরাজিত ও নিহত করে আপন বুদ্ধিমত্তা ও রণকৌশলের বলে বাংলার নবাবী লাভ করেন।


নবাব আলীবর্দী খাঁর তিন কন্যা ছাড়া কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তিনি তাঁর তিন কন্যাকে আপন বড় ভাই হাজী আহমাদের তিন পুত্রের সঙ্গে বিবাহ দেন। তাঁর তিন জামাতাই তিনটি পর্গনার শাসনকর্তা ছিলেন। একজন ঢাকার, একজন পূর্ণিয়ার এবং ছোট জামাতা জৈনুদ্দীন ছিলেন বিহারের নায়েবে-নাযিম। এদিকে নবাব আলীবর্দী খাঁ কর্তৃক পদচ্যুত সমসের খাঁ ও সরদার খাঁ নামে দুই আফগান বীর বিদ্রোহ করলে তাদেরকে বশ্যতা স্বীকার করার জন্য রাজ দরবারে ডেকে পাঠানো হয়। তারা বশ্যতা স্বীকারের ছলে ১৭৪৮ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারী যথাযোগ্য সমাদরে জৈনুদ্দীনের নিকটে উপস্থিত হয়ে অতর্কিতে তাঁর উপর আক্রমণ চালায়। জৈনুদ্দীন নিজ তরবারী কোষমুক্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর ছিন্নমুন্ডু মসনদের উপর লুটিয়ে পড়ে। হাজী আহমাদ বন্দী দশায় নিদারুণ উৎপীড়ন সহ্য করতে না পেরে সতের দিনের মাথায় ভগ্নহৃদয়ে বন্দীশালায় মৃত্যুবরণ করেন। সিরাজুদ্দৌলার মাতা ও নবাব আলীবর্দী খাঁর ছোট মেয়ে আমেনা বেগম সন্তান-সন্ততিসহ আফগান শিবিরে বন্দী হ’লেন। এই মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক সংবাদ পাওয়া মাত্রই নবাব আলীবর্দী খাঁ আফগান বিদ্রোহ দমন এবং তাদের হাত থেকে দুহিতার বন্ধন মোচন করতে বিহারের উদ্দেশ্যে সসৈন্যে যাত্রা করেন। এক্ষেত্রে তিনি পদচ্যুত ও পদগৌরবান্বিত সকল সেনাপতিকে সম্মিলিত করে কাতর কণ্ঠে যখন এই শোকাবহ কাহিনী বর্ণনা করেন, তখন সকলে একে একে কুরআন স্পর্শ করে নাঙ্গা তরবারী হাতে নিয়ে তাঁর সঙ্গে প্রাণ-বিসর্জ্জনের শপথ করেন। এ উপলক্ষে পূর্বের সকল কলহ-বিবাদ মিটে গেল, মীরজাফর পুনরায় সেনাপতি পদে নিযুক্ত হ’লেন। সিরাজুদ্দৌলা তখন বয়সে বালক হ’লেও এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় অতিমাত্রায় ব্যাকুল হয়ে উঠেন। কারণ তাঁর পিতা ও পিতামহ শত্রুর হাতে নিহত এবং মাতা বন্দিনী। এমত পরিস্থিতিতে তিনিও তরবারী হাতে মাতামহের সাথে যুদ্ধে যাত্রা করলেন। অতঃপর ১৭৪৮ সালের ১৬ই এপ্রিল গঙ্গার তীরবর্তী কালাদিয়ারা নামক স্থানে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াইয়ে বিদ্রোহী সমসের খাঁ নিহত হয় এবং তার সহযোগী বাহিনীকে  বিধ্বস্ত  করে আলীবর্দী খাঁ বন্দী কন্যা ও তাঁর সন্তানদের মুক্ত করার মাধ্যমে বিহার পুনরুদ্ধার করেন। নবাব আলীবর্দী খাঁ তখন নিজ স্ত্রী শরফুন্নেসার সাথে পরামর্শ করে নিহত জামাতা জৈনুদ্দীনের সুযোগ্য উত্তরসূরী ও নবাবের প্রিয় দৌহিত্র সিরাজুদ্দৌলাকে বিহারের পরবর্তী নায়েবে-নাযিম নিযুক্ত করেন। এটা ছিল তাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার একটা অংশ। যেহেতু সিরাজুদ্দৌলা তখন বয়সে বালক, তাই রাজা জানকীরামকে বিহারে সিরাজের নায়েব নিয়োগ করা হ’ল।


যেহেতু নবাব আলীবর্দী খাঁর কোন পুত্র সন্তান ছিল না, তাই তিনি মৃত্যুর পূর্বেই তাঁর কনিষ্ঠ কন্যার পুত্র প্রিয় দৌহিত্র সিরাজুদ্দৌলাকে বাংলার পরবর্তী নবাব মনোনীত করে যান।১০ এদিকে হঠাৎ করে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে তাঁর অন্য এক দৌহিত্র এবং দুই জামাতার (ও ভ্রাতুষ্পুত্র) মৃত্যুতে তিনি খুবই শোকাভিভূত হয়ে পড়েন এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যান। যার ফলে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে ১৭৫৬ সালের ১০ই এপ্রিল ৮০ বছর বয়সে নবাব আলীবর্দী খাঁ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।১১ অবশ্য নবাব আলীবর্দী খাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর তিন জামাতাই মৃত্যুবরণ করেন। নানার মৃত্যুর পর তাঁরই মনোনীত প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র সিরাজুদ্দৌলা বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র তেইশ বছর।১২ তাঁর নিকট আত্মীয়ের মধ্যে অনেকেই নবাব আলীবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর সিংহাসন লাভের আশায় বুক বেঁধে ছিলেন। তাই তিনি যখন সিরাজুদ্দৌলাকে পরবর্তী নবাব মনোনীত করেন, তখন স্বভাবতই অন্যদের অন্তরে চাপা অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। যার ফলে তারা মনে-প্রাণে সিরাজকে নবাব হিসাবে মেনে নিতে পারেনি। তাই নবাব আলীবর্দী খাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা এবং ঢাকার ভূতপূর্ব শাসনকর্তার বিধবা পত্নী মেহেরুন্নেসা ওরফে ঘসেটি বেগম পূর্ণিয়ার ভূতপূর্ব শাসনকর্তার পুত্র শওকত জঙ্গ সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই সুযোগে ধূর্ত বৃটিশ কোম্পানী নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের নিমিত্তে গোপনে শওকত জঙ্গ ও ঘসেটি বেগমের পক্ষাবলম্বন করে। এমনকি নতুন নবাব হিসাবে ইংরেজগণ সিরাজকে উপঢৌকন প্রেরণের চিরাচরিত রীতিও অমান্য করে।১৩ এ সময় রাজা রাজবল্লভ ঢাকার দেওয়ান ছিলেন। নবাব সিরাজুদ্দৌলা তাকে হিসাব দাখিল করতে বললে সে নবাবের নির্দেশ অমান্য করে নিজ পুত্র কৃষ্ণদাস মারফত প্রচুর ধনরত্নসহ কলকাতায় পাঠায়। এ সংবাদ নবাব সিরাজ জানতে পেরে কৃষ্ণদাসকে গ্রেফতারের আদেশ দিলে ইংরেজরা তাকে আশ্রয় দেয়।


নবাবের বিরুদ্ধে ঘসেটি বেগম, রাজা রাজবল্লভ প্রভৃতির ষড়যন্ত্রে যে ইংরেজরাও জড়িত, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ ছিল না। এমতাবস্থায় ইউরোপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের (১৭৫৬-১৭৬৩) অজুহাতে ইংরেজও ফরাসি বণিকরা বাংলায় দুর্গ নির্মাণ শুরু করে। নবাব এ সংবাদ জানতে পেরে তাদেরকে নিরস্ত্র হ’তে এবং দুর্গ নির্মাণ বন্ধ করার আদেশ দেন। ফরাসিগণ নবাবের নির্দেশ মত দুর্গ নির্মাণ বন্ধ করলেও উদ্ধত বৃটিশ বণিকরা নবাবের আদেশ তো মানেইনি; উপরন্তু তাঁর দূতকে তারা অপমান করতেও দ্বিধা করেনি। এমনকি নবাব কৃষ্ণদাসের সমর্পণ দাবী করলেও তারা তা অমান্য করে। এ প্রসঙ্গে ইংরেজ কর্মচারী রিচার্ড বেচারের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘এটা কি কখনও কল্পনা করা যায় যে, কোন নৃপতির প্রজাকে একদল বিদেশী বণিক আশ্রয় দেবে? কিংবা তাঁর দূতকে অপমানিত করলে রাজা সে অপমান নির্দ্বিধায় মেনে নেবেন? দূতকে ফেরত দেওয়াটা পুরো দুনিয়াতে রাজার অবমাননা বলে মনে করা হবে’।১৪
ইত্যবসরে বুদ্ধিমান সিরাজ বিনা রক্তপাতে সুকৌশলে বড় খালা অর্থাৎ ঘসেটি বেগমকে নিজ প্রাসাদে আনতে সমর্থ হন। নবাব বিরোধী ষড়যন্ত্রের প্রধান হোতা এভাবে সিরাজের হাতে বন্দী হয়েছে, জানতে পেরে বৃটিশ বণিকেরা ঘসেটি বেগমের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার বিপদ অাঁচ করতে পারে। এতে তড়িঘড়ি করে পূর্বের আচরণের জন্য সিরাজের নিকট অনুতাপ প্রকাশ করে। নবাব তখন ইংরেজদেরকে অবিলম্বে দুর্গ নির্মাণ বন্ধ এবং নির্মিত অংশ ভেঙ্গে ফেলার আদেশ দেন।


এদিকে ঘসেটি বেগমকে রাজদরবারে অন্তরীণ রেখে অপর ষড়যন্ত্রকারী শওকত জঙ্গকে দমনের উদ্দেশ্যে নবাব ১৭৫৬ সালের ১৬ই মে মুর্শিদাবাদ থেকে সসৈন্যে পূর্ণিয়ার দিকে অগ্রসর হন। ২০শে মে নবাব যখন রাজমহল পৌঁছেন তখন রোজার ড্রেকের পত্র তাঁর হস্তগত হয়। এ পত্রে ড্রেক অত্যন্ত বিনম্র ভাষায় ইংরেজদের সদিচ্ছার কথা জানালেও তাতে দুর্গ নির্মাণ বন্ধ কি-না সে বিষয়ের উল্লেখ না থাকায় নবাব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। এতে নবাব পূর্ব সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পূর্ণিয়ার দিকে না গিয়ে মুর্শিদাবাদে ফিরে এসে ইংরেজদেরকে উপযুক্ত শাস্তিদানের উদ্দেশ্যে সসৈন্যে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ান হন। পথিমধ্যে তিনি কাশিম বাজারের ইংরেজ কুঠি দখল করে নিয়ে ১৬ই জুন কলকাতার উপকণ্ঠে পৌঁছেন। যদিও সংবাদ পেয়ে নবাবের গতিরোধ করতে হলওয়েল যথাসাধ্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেছিল, তথাপি কলকাতাস্থ ইংরেজ ঘাঁটি ফোর্ট উইলিয়াম দখল করতে নবাবকে বেগ পেতে হয়নি। যুদ্ধে ইংরেজ পক্ষের বেশ কিছু সৈন্য নিহত হয়। গভর্নর হলওয়েল আত্মসমর্পণ করেন এবং রোজার ড্রেকসহ অপরাপর ইংরেজরা দুর্গ ত্যাগ করে নদী পথে পলায়ন করে ফুলতায় আশ্রয় নেয়। এমনি পরিস্থিতিতে ২০শে জুন নবাব সিরাজুদ্দৌলা বিজয়ী বেশে কলকাতা দুর্গে প্রবেশ করেন। অতঃপর কলকাতার অভিযান সমাপ্ত করে মাণিক চাঁদের উপর কলকাতার ভার অর্পণ করে নবাব পুনরায় মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন।


ইতিমধ্যে শওকত জঙ্গ নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে মসনদ থেকে অপসারণের লক্ষ্যে যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন। এদিকে নবাবও কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ ফিরে এসে শওকত জঙ্গকে দমনের জন্য ১৭৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে সসৈন্যে পূর্ণিয়া অভিমুখে অগ্রসর হন। ১৭৫৬ সালের ১৬ই অক্টোবর নবাবগঞ্জের মনিহারী গ্রামে দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধে শওকত জঙ্গ পরাজিত ও নিহত হন।১৫ ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে নবাব সিরাজুদ্দৌলা ঘসেটি বেগম, ইংরেজ ও শওকত জঙ্গের মত তিনটি প্রধান ষড়যন্ত্রকারীকে কঠোর হস্তে মোকাবেলা করতে সমর্থ হন।
এদিকে নবাব কর্তৃক কলকাতা অধিকারের সংবাদ মাদ্রাজে পৌঁছলে বৃটিশ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ সঙ্গে সঙ্গে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে কলকাতা পুনরুদ্ধারে বেরিয়ে পড়েন। একই সাথে এডমিরাল ওয়াটসনের নেতৃত্বে এক নৌবহরও কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। প্রথমে তারা ফুলতায় এসে বিনা বাধায় উদ্বাস্ত্ত ইংরেজদের সাথে মিলিত হয়। অতঃপর সম্মিলিতভাবে কলকাতার দিকে যাত্রা করে। মানিক চাঁদের নেতৃত্বে কিছু সৈন্য অতর্কিতে তাদের উপর হামলা চালালে ইংরেজদের বেশ কিছু সৈন্য নিহত হয়। কিন্তু অর্থের প্রলোভনে শেষ পর্যন্ত মানিক চাঁদ ইংরেজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে পালিয়ে যান। এই সুযোগে ইংরেজরা নবাবের বজবজ দুর্গ ধ্বংস করে এবং ১৭৫৭ সালের ২রা জানুয়ারী কলকাতা অধিকার করে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সুরক্ষিত করে। এক্ষেত্রে মানিক চাঁদ গোপনে ইংরেজদের পক্ষাবলম্বন করে চরম বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দেয়। অথচ কলকাতা পতনের পর যদি উমিচাঁদ, নবকিষেণ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, মানিক চাঁদের মত হিন্দু-প্রধানরা রজার ড্রেক, হলওয়েল, ক্লাইভ, ওয়াটসনদের সাহায্য না করত, তাহ’লে ইংজেদের আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না।


কলকাতা অধিকার করেই ইংরেজরা পরের দিন ৩রা জানুয়ারী নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অপর দিকে নবাবও এ সংবাদ জানতে পেরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। ইতিমধ্যে ক্লাইভ ১০ই জানুয়ারী হুগলী অধিকার করে শহর লুণ্ঠন করে এবং পার্শ্ববর্তী বহু গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। ১৯শে জানুয়ারী নবাব হুগলী পৌঁছলে ইংরেজরা পিছু হটে কলকাতায় প্রস্থান করে। ৩রা ফেব্রুয়ারী নবাব কলকাতার শহরতলীতে উমিচাঁদের বাগানে শিবির স্থাপন করলে ৫ই ফেব্রুয়ারী শেষ রাতে ক্লাইভ ও ওয়াটসন অকস্মাৎ নবাব শিবিরে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে নবাবের পক্ষের প্রায় ১৩০০ সৈন্য হত্যা করে। কিন্তু সকালেই নবাবের সৈন্য সুসজ্জিত হয়ে পাল্টা আক্রমণ চালালে ক্লাইভ প্রস্থান করে। সেদিন কলকাতা জয়ের মত নবাবের যথেষ্ট সৈন্য ও শক্তি থাকার পরও ৯ই ফেব্রুয়ারী’৫৭ সেনাপতির পরামর্শে ও ষড়যন্ত্রে নবাব ইংরেজদের সাথে এক অপমানজনক সন্ধি স্থাপনে সম্মত হন। যে সন্ধি ‘আলিনগর সন্ধি’ নামে অভিহিত হয়।১৬ এই সন্ধির ফলে নবাবের প্রতিপত্তি অনেকাংশে হরাস পায় এবং ইংরেজের শক্তি, প্রতিপত্তি ও ঔদ্ধত্য বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এ ক্ষেত্রে ইংরেজদের পক্ষে কাজ করেন বঙ্গের বিখ্যাত ধনী জগৎশেঠ, কলকাতার বড় ব্যবসায়ী উমিচাঁদ ও রাজা রাজবল্লভ, মানিক চাঁদ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
এ ঘটনায় ইংরেজদের মনোবলও বৃদ্ধি পায়। ফলে ২৩শে এপ্রিল’৫৭ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কলকাতা কাউন্সিল নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।১৭ এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মে’৫৭-র প্রথম সপ্তাহে মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠের বাড়িতেই উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, রাজা রাজবল্লভ, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, জগৎশেঠ, মীরজাফর প্রমুখ প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের এক গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।১৮ উক্ত ষড়যন্ত্রমূলক গোপন বৈঠকে কলকাতা থেকে কোম্পানীর দূত হিসাবে ওয়াটসনকে স্ত্রীলোকের ছদ্মবেশে পালকীতে করে আনা হয়।১৯


বৈঠকে বসে ওয়াটসন প্রথমে সকলকে প্রলোভনের জালে অাঁটকে ফেলে। অতঃপর সিরাজুদ্দৌলার সিংহাসনচ্যুত করার কথা সুকৌশলে ব্যক্ত করে। ওয়াটসন আরো বলে, নবাব ক্ষমতাচ্যুত হ’লে সারা ভারতের মুসলমানদের উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষ্যে তাঁরই আত্মীয় মীরজাফরকে সিংহাসনে বসাতে হবে। মীরজাফর প্রথমে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি ছিলেন পরলোকগত নবাব আলীবর্দী খাঁর ভগ্নীপতি এবং বাংলার সিপাহসালার। তিনি সিরাজুদ্দৌলা কর্তৃক ক্রমাগত অপমানিত ও পদচ্যুত হ’লেও নিজে কখনো সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার কল্পনাও করেননি। তিনি বলেন, ‘আমি নবাব আলীবর্দী খাঁর আত্মীয়, অতএব সিরাজও আমার আত্মীয়, এটা কি করে সম্ভব?’ তখন উমিচাঁদ বললেন, ‘আমরা তো আর সিরাজকে মেরে ফেলছি না অথবা আমরা নিজেরাও নবাব হচ্ছি না, শুধু তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে আপনাকে বসাতে চাচ্ছি। কারণ শুধু আমি নই, ইংরেজ এবং মুসলমানদের অনেকেই, এক কথায় অমুসলমানদের প্রায় প্রত্যেকেই আপনাকে গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখে’।২০ এরপরও যখন দেখলেন, তিনি রাজি না হ’লে তারা নবাবকে হটিয়ে সেখানে ইয়ার লতিফকে বসানোর ষড়যন্ত্র করছে; তখন তিনি আর উদাসীন না থেকে তাদের প্রস্তাবে সম্মত হ’লেন। তখন ওয়াটসন বলেন, এই মুহূর্তে সিরাজের সাথে লড়তে গেলে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তা আমাদের নেই। তখন জগৎশেঠ বলেন, ‘টাকা যা দিয়েছি আরও যত দরকার আমি আপনাদের দিয়ে যাব, কোন চিন্তা নেই, আপনারা প্রস্ত্ততি নিন’।২১ তখন উপস্থিত দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে ইংরেজ কোম্পানীর মধ্যে শুধু নবাব বিরোধী নয়, সাথে সাথে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী একটি সন্ধিপত্র রচিত হয়। উক্ত সন্ধিপত্রে ওয়াটসন ১৯শে মে স্বাক্ষর করলেও মীরজাফর স্বাক্ষর করেন ৪ঠা জুন।


এবার রবার্ট ক্লাইভ সামান্য অজুহাতে নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। নবাবও ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে সসৈন্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন প্রাতঃকালে ভাগীরথীর তীরে পলাশীর প্রান্তরে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। নবাবের সৈন্য সংখ্যা ৫০ হাজার, অপর দিকে ইংরেজ সৈন্য সংখ্যা মাত্র ৩ হাজার। মীরজাফর ও রায়দুর্লভদের চক্রান্ত্রে নবাবের সৈন্যের একটা বড় অংশ যুদ্ধ থেকে বিরত থাকে। কেবল মীর মদন, মোহনলাল ও সিনফ্রের অধীনে মুষ্টিমেয় কিছু সৈন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। মীরমদন ও মোহনলালের সমরকুশলতার সম্মুখে ইংরেজ বাহিনী টিকতে না পেরে ক্লাইভের সৈন্য বাহিনী পার্শ্ববর্তী আম্রকাননে আশ্রয় নেয়। নবাব বাহিনীর জয় যখন সুনিশ্চিত, ঠিক সেই মুহূর্তে মীরমদন নিহত হন। অনন্যোপায় হয়ে নবাব তখন মীরজাফরের শরণাপন্ন হন। তিনি আলীবর্দী খাঁর আমলের আনুগত্যপূর্ণ ব্যবহারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নিজ উষ্ণীষ মীরজাফরের সম্মুখে নিক্ষেপ করে বললেন, ‘জাফর খাঁ, এই উষ্ণীষের সম্মান রক্ষা করুন’।২২
তখন মীরজাফর মুখে আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দিলেও তলে তলে সবচেয়ে বড় সর্বনাশটাই করলেন। তিনি সিরাজকে যুদ্ধ বিরতির আত্মঘাতী পরামর্শ দিলেন। অথচ মীর মদনের মৃত্যুর পর মোহনলালের প্রচেষ্টায় যুদ্ধের গতি নবাবের অনুকূলেই ছিল। কিন্তু নিজ অদূরদর্শিতা ও মীরজাফরের সর্বনাশা পরামর্শে তিনি মোহনলালকে যুদ্ধ বন্ধের আদেশ দেন। প্রথমে মোহনলাল তাঁর আদেশ মানেননি। কিন্তু নবাবের নিকট থেকে পুনঃ পুনঃ আদেশের ফলে তিনি যুদ্ধ বন্ধ করেন। এই সুযোগে রবার্ট ক্লাইভ পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে নবাব বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। নবাব পালিয়ে গিয়ে কোনক্রমে প্রাণে রক্ষা পান। যুদ্ধক্ষেত্রেই রবার্ট ক্লাইভ মীরজাফরকে নতুন নবাব বলে অভিনন্দন ও কুর্নিশ করে।২৩ ২৬শে জুন তাঁর অভিষেক হয় এবং ২৯শে জুন সিংহাসনে আরোহণ করেন। নবাব সিরাজুদ্দৌলা রাজধানীতে ফিরে এসে প্রচুর অর্থ বিতরণ করে সৈন্য সংগ্রহের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অবশেষে নিরুপায় হয়ে তিনি স্বীয় পত্নী ও কন্যাসহ পালিয়ে যান। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস পথিমধ্যে রাজমহলে রাত কাটাতে গিয়ে ৩০শে জুন তিনি ধরা পড়েন।


২রা জুলাই রাতে সাধারণ বন্দীর মত শৃঙ্খলিত অবস্থায় সিরাজুদ্দৌলাকে নতুন নবাব মীরজাফরের সম্মুখে উপস্থিত করা হয়। ঐ রাতেই মীরজাফরের পুত্র মীরণের আদেশে মুহাম্মাদী বেগ তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
নবাবকে হত্যা করতে মুহাম্মাদী বেগ রাযী না হ’লে তারা তার ও তার স্ত্রী-পুত্রের প্রাণনাশের হুমকী দেয়। অনন্যোপায় হয়ে অশ্রু সম্বরণ করে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিকল্পনামাফিক সংকেত পাওয়া মাত্র সিরাজুদ্দৌলাকে হত্যা করতে সম্মত হন। মুহাম্মাদী বেগ যখন উলঙ্গ তরবারী নিয়ে রাতে তাঁর কক্ষে প্রবেশ করেন, তখন নবাবের আর বুঝতে বাকি ছিল না, তাঁর মৃত্যুর সময় সমাগত। তখন তিনি কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘মুহাম্মাদী বেগ, আমাকে কি তোমরা সামান্য একটা অসহায় গরীবের মত বেঁচে থাকতেও দেবে না?’ তখন মুহাম্মাদী বেগও দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘না তারা তা দেবে না’। তখন নবাব মুহাম্মাদী বেগকে বলে দু’রাক‘আত ছালাত আদায়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে ছালাত শেষ হওয়ার আগেই দূর থেকে বাঁশি বাজিয়ে সংকেত দেওয়া মাত্র তাঁর উপরে তরবারী চালানো হয়। নবাব সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটে পড়ে ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ শব্দ করতে করতে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিলেন।২৪ এটাই হল পলাশীর প্রান্তরের নির্মম ট্র্যাজেডি।


বাহ্যিকভাবে নবাব সিরাজুদ্দৌলার চরম পরিণতির জন্য শেষ দিকের কিছু ঘটনাবলীর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত কয়েকজন বিশ্বাসঘাতককে দায়ী করা হ’লেও মূলতঃ পলাশীর বিয়োগান্ত ঘটনা কোন কাকতালীয় বিষয় ছিল না। এটি ছিল বৃটিশ বেনিয়াদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার চূড়ান্ত পরিণতি। প্রথম থেকেই যদি জগৎশেঠের মত এদেশের নামী-দামী ধনাঢ্য এবং পরবর্তীতে ক্ষমতালোভী কিছু মীরজাফরা ইংরেজদের সহযোগিতা না করত, তাহ’লে কোন দিনই ইংরেজরা এদেশের মানুষদেরকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে সমর্থ হ’ত না। বাংলার এসব বিশ্বাসঘাতকরা কখনই উপলব্ধি করতে পারেনি যে, নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয় শুধু তাঁর একার পরাজয় নয়, শুধু বাংলার পরাজয় নয়, বরং সমগ্র ভারতবাসীর পরাজয়। তবে অতি অল্প সময়ের ব্যবধানেই, অতি সহজেই তারা এই চরম সত্য বিষয়টি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এক্ষেত্রে মীরজাফরদের বিশ্বাসঘাতকতার চেয়ে শেঠজীদের বিশ্বাসভাতকতায় ইংরেজরা বহুগুণ বেশী উপকৃত হয়েছিল। তারা শুধু পলাশীর যুদ্ধেই নয়, বহু আগে থেকেই ইংরেজদের নানাভাবে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে আসছিল। একারণেই ইংরেজ ঐতিহাসিকগণও এই বিরাট সত্যটা অকপটে স্বীকার করেছেন, The rupees of the Hindu banker equally with the sword of the English Colonel contributed to the over through of the Mahamedan power in Bengal. ‘বাংলায় মুসলমানদের শক্তিকে খর্ব করে পরাধীন করতে বৃটিশ তরবারীর সাথে হিন্দু ধনপতিদের অর্থভান্ডারও সমানভাবে সহযোগিত করেছিল’।২৫ শেঠরা শুধু ইংরেজদেরকেই টাকা দেয়নি, সিরাজুদ্দৌলার অনেক সৈন্যকে পর্যন্ত অর্থ দিয়ে নিষ্ক্রীয় রেখে বাংলার ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। আরো দুঃখের কথা হ’ল বন্দী সিরাজুদ্দৌলাকে হত্যা করার প্রস্তাব এই জগৎশেঠই দিয়েছিল।২৬ এর মাধ্যমে পবিত্র কুরআনের চিরন্তন ঘোষণা বাস্তবে প্রতিফলিত হ’ল। বিধর্মীদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্কের বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, لَا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُوْنَ الْكَافِرِيْنَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُوْنِ الْمُؤْمِنِيْنَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللهِ فِيْ شَيْءٍ. ‘মুমিনগণ যেন  মুমিন ছাড়া কোন কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না’ (আলে ইমরান ২৮)। অর্থাৎ একজন বিধর্মী কোন দিনই কোন মুসলমানের প্রকৃত বন্ধু হ’তে পারে না। সুতরাং তাদের থেকে সর্বদা সর্তক থাকা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব।


পলাশীর পরাজয়ের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশের সাড়ে পাঁচশ’ বছরের মুসলিম শাসন ও আধিপত্যের অবসান ঘটে। এর মাধ্যমে সকল ক্ষেত্রে ভারতের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ফলে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নতুন নবাব বৃটিশ বেনিয়াদের হাতের পুতুলে পরিণত হওয়ায় এ রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসক কে? এই প্রশ্নে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এক কথায় বাংলায় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এক ভয়াবহ শূন্যতার উদ্ভব হয়, যা বাংলার জনগণের জন্য এক মারত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পরিশেষে বলা যায়, নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে পরাজিত করে ভারতবর্ষকে গ্রাস করতে তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যেরূপে এদেশের হিন্দু ধনিক শ্রেণীকে হাত করার পাশাপাশি স্বার্থান্বেষী মুসলমানদের মিথ্যা প্রলোভনে কাবু করে ছিল, আধুনিক বিশ্বেও সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে সকল দিকে থেকে কোণঠাষা করতে ইসলাম বিরোধী পরাশক্তিগুলো যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই মুসলমানদের সময় এসেছে পলাশীর মর্মান্তিক পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণের। মহান আল্লাহ আমাদের সে তাওফীক দান করেন- আমীন!!

. কে এম. রাইছউদ্দিন খান, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা (ঢাকা : খান ব্রাদার্স এ্যান্ড কোম্পানি, ৯ম সং., ১৯৯৯), পৃঃ ৪৭৬।
. ফারুক মাহমুদ, ইতিহাসের অন্তরালে  (ঢাকা : ওয়েসিস বুকস্, ১৯৮৯), পৃঃ ২০৩।
.   গোলাম আহমাদ মোর্তজা, চেপে রাখা ইতিহাস (ঢাকা : মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ রিসার্চ একাডেমী, ২০১০), পৃঃ ১৫৫।
. বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা, পৃঃ ৪৯৩।
. তদেব।
. অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, সিরাজদ্দৌলা (ঢাকা : দিব্য প্রকাশ, ২০০৩), পৃঃ ৩৪।
. সিরাজদ্দৌলা, পৃঃ ৩৪।
. বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা, পৃঃ ৪৮১।
. সিরাজদ্দৌলা, পৃঃ ৩৭।
১০. গোলাম আহমাদ মোর্তজা, ইতিহাসের ইতিহাস, (ঢাকা : মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ রিসার্চ একাডেমী, ২০০৯), পৃঃ ১৮৫।
১১. বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা, পৃঃ ৪৮২।
১২. তদেব, পৃঃ ৪৯৩।
১৩. মোঃ আবু তাহের, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও পলালীর ট্রাজেডি (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৯), পৃঃ ৮৫।
১৪. তদেব, পৃঃ ৮৯।
১৫. বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা, পৃঃ ৪৯৬।
১৬. মুহাম্মদ আবদুর রহীম, বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস (ঢাকা : আহমদ পাবলিশিং হাউস, ১৯৯৪), পৃঃ ৯।
১৭. ইতিহাসের অন্তরালে, পৃঃ ১৫৭।
১৮. তদেব।
১৯. চেপে রাখা ইতিহাস, পৃঃ ১৫৫।
২০. তদেব, পৃঃ ১৫৬।
২১. তদেব, পৃঃ ১৫৫।
২২. বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা, পৃঃ ৫০১।
২৩. তদেব।
২৪. অক্ষয় কুমার মৈত্র, সিরাজুদ্দৌলা ও পুরানা কলকাতার কথাচিত্র (কলকাতা : ১৮৯৮), পৃঃ ৩৯৩।
২৫. চেপে রাখা ইতিহাস, পৃঃ ১৫৮।

বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদান (১ম কিস্তি)

[‘মক্তব’ পাঠচক্রের ১৩তম পর্বে এই বিষয়ে আলোচনা হয়। বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদানকে সঠিকভাবে পাঠ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি থেকেই এই বিষয়কে বাছাই করা হয়েছিল। আলোচনার সংক্ষিপ্তসার নিয়েই এই লেখাটি প্রস্তুত করা হলো।]

বর্তমান সময়ে এসে বাংলা সাহিত্যে ‘মুসলিম অবদান’ আলোচনা করা কেন এতো দরকার? 
 এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়- অতীত ইতিহাস একটি জাতির প্রাণ এবং সাহিত্য হলো জাতির দর্পণ। বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বোঝার ক্ষেত্রেও এ ভাষায় সাহিত্যের ঐতিহাসিক ধারাটা জানা জরুরি। বর্তমান সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদানকে অস্বীকার করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। মুসলিম অবদান অস্বীকার নাকি মুসলিম অবদানের শূণ্যতা- এই প্রশ্নকে সামনে রেখেই বর্তমান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলায় বিশেষভাবে বাংলা সাহিত্যে ‘মুসলিম অবদান’ পাঠ জরুরী।

দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি সম্মুখে আসে সেটি হলো- আমরা এই ইতিহাস কিভাবে পড়বো? 
 জবাব হচ্ছে- বাজারে অনেক ইতিহাস প্রচলিত আছে যেগুলোতে ইতিহাসের বিকৃতি লক্ষ্যণীয়। তৎকালীন সাহিত্যের ধারায় মুসলিমদের যে অবদান, তা তৎকালীন সমাজের সামাজিক, রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে খুবই প্রাসঙ্গিক। তখনকার শাসকদের ধর্মীয় পরিচয় ভিন্ন থাকায় পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিকগন স্বধর্মপ্রীতির কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সত্যের অপলাপ ঘটিয়েছেন। যার ফলে বিভিন্ন পর্যায়ে মুসলিম অবদানকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই_ প্রকৃত সত্যের আলোকে এই ইতিহাস পড়া জরুরি।

বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করলে প্রথমেই প্রশ্ন আসে- বাংলা ভাষা ও সাহিত্য কি? ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করা খুবই দূরহ ব্যাপার। কারণ, ভাষা দিয়েই অন্য সবকিছু সংজ্ঞায়িত করা হয়। ভাষা মনের ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যম। পৃথিবীতে প্রায় চার হাজার ভাষা রয়েছে। ভাষাভাষী জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলা ভাষা পৃথিবীতে চতুর্থ। পৃথীবির অন্যান্য ভাষা তার বৈশিষ্টের কারণে নামকরন করা হয়েছে কিন্তু বাংলা ভাষা স্থানের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যই বাংলা সাহিত্য। সাহিত্য একটা লিখিত কর্ম, যা কবি বা সাহিত্যিকদের দ্বারা রচিত হয়।

এই আলোচনায় বাংলা ভাষার ইতিহাস জানাও খুবই জরুরি। ভাষা কোন প্রাণীর মতো নয় যে বলা যাবে অমুক বছর, অমুক মাস, অমুক দিন, এতোটায় জন্ম লাভ করেছে! ভাষা একটি চলমান নদীর মতো। নদী যেমন এঁকেবেকে চলে, বিভিন্ন শাখা প্রশাখা বের হয় ঠিক তেমনি ভাষাও বিকৃত হয়ে বিভিন্ন ভাষার জন্ম দেয়। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে উপমহাদেশে জনবসতি শুরু হয়। চীন থেকে অনার্যগণ এ দেশে এসে বসবাস শুরু করে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ২০০০ বছর পূর্বে উপমহাদেশে আর্যগণ আসে ইরান ও বলকান অঞ্চল থেকে। তাঁদের মাঝে যে ভাষাগোষ্ঠীর জন্ম হয় তা হলো ইন্দোইউরোপীয় ভাষা। “ইন্দোইউরোপীয় ভাষার ‘শতম’ শাখা থেকে ইন্দো ইরানীয় হয়ে প্রাচীন ভারতীয় আর্য থেকে ইন্দো আর্য হয়ে গৌড়িয় প্রাকৃত হয়ে বঙ্গকামরুপী থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়।“ বাংলা ভাষার জন্ম ৭ম শতাব্দীতে পাল আমলে এবং লিখিত রুপ চালু হয় তখন থেকেই। তখনকার প্রাপ্ত একমাত্র গ্রন্থ চর্যাপদ।


বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগঃ
 
 • ৬৫০-১২০০ খ্রি প্রাচীন যুগ।
 • ১২০১-১৮০০ খ্রি মধ্যযুগ।
 • ১৮০১- বর্তমান আধুনিক যুগ।
এই বঙ্গে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ করা হয়। বাংলা ভাষার জন্ম থেকে বখতিয়ার খিলজীর আগমন পর্যন্ত প্রাচীন যুগ, বখতিয়ারের আগমন থেকে মধ্যযুগ এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আধুনিক যুগের সূচনা। এর মাঝে আরেকটা যুগের অবতারনা ঘটানো হয়েছে ১২০১-১৩৫০খ্রি পর্যন্ত অন্ধকার যুগ নামে। এখন আমরা দেখব এই অন্ধকার যুগের অস্তিত্ব আদৌ আছে কিনা আর যদি থেকেই থাকে তাহলে সেটা কোন আমলে? আসলেই কি এ যুগে কোন সাহিত্য রচনা হয়নি?

ইতিহাসের আলোকে পাঠ করলে আমরা জানতে পারি – বৌদ্ধ শাসক পাল বংশের (৬৫০-১১২৫ খ্রি) আমলে বাংলা ভাষার জন্ম এবং এ ভাষার একমাত্র প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ এ যুগেই রচিত। এরপর বিজয় সেন ক্ষমতা দখল করে ১০৯৭খ্রিষ্টাব্দে। ব্রাহ্মণ সেন বংশ ‘কৌলিন্য’ প্রথার প্রচলন করে, বৌদ্ধদের উপর নির্মম নির্যাতন-অত্যাচার চালায়। ফলে, বৌদ্ধ সহজিয়াগণ প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাংলার সমতল ভূমি ছেড়ে নেপালে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং সেনরা বাংলা ভাষার টুটি চেপে ধরে, রাজ্যে সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ঘটায়। তাদের নিয়মানুযায়ী ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য কেউ সংস্কৃত ভাষা পড়তে পারত না এবং নিজ ভাষায় তাদের ধর্মগ্রন্থ বুঝবার অধিকারও কারও ছিলো না। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগ্ণ ফতোয়া দিলো – ‘নম্লেচ্ছ ভাষা শিক্ষেত’, ‘অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ। ভাষায়াং মানবঃশ্রত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ’ কিংবা বাংলা ভাষায় যারা ধর্মগ্রন্থ পড়বে তারা রৌরব নামক নরকে জ্বলবে প্রভৃতি। সমগ্র বাংলায় মারাত্মক নৈরাজ্য শুরু হয়ে যায়। আর বিশৃঙ্খল অবস্থায় কখনও সাহিত্য চর্চা সম্ভব নয় এবং হয়ও না। মূলত এই সময়ে বাংলা সাহিত্যে বিশাল শূন্যতা্র সৃষ্টি হয়। অথচ হিন্দু ঐতিহাসিকরা সেনদের অত্যাচারের ফলে যে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয় এটাকে তারা মুসলিম শাসকদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। 

আসলে কাগজের উপর লেখা সুন্দর হবে শুধু কাগজ পরিষ্কার থাকলেই নয় বরং মগজ পরিষ্কার থাকলে তবেই। অথচ মগজে বেশির ভাগ ইংরেজ পঙ্কিল, পক্ষপাতিত্ব ও অনেকের যোগ্যতার অভাব অস্বীকার করা যায় না। আসলে একফোঁটা কলমের কালি একটা এটোম বোমার চেয়েও ক্ষতিকর, যদি তা ভুল পথে ব্যবহৃত হয়।

বিনা বাঁধায় এবং রক্তপাতহীন অবস্থায় নদীয়া বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলমান শাসনের সূচনা হওয়ার পর সেখানে হত্যাযজ্ঞ, হামলা, আগ্রাসন, ধ্বংসযজ্ঞ এসব কেবল কল্পনায়ই হতে পারে এবং নিন্দুকেরাই তার প্রচার কাজে যুক্ত থাকতে পারে। এ সময় বিজাতীয় মনোভাবাপন্ন ইতিহাসকারেরা মনে করেছেন মধ্যযুগের ‘দেড়’শ, দু’শ কিংবা আড়াই’শ বছর ধরে হত্যাকাণ্ড ও অত্যাচার চালানো হয় কাফেরদের ওপর। তাদের জীবন জীবিকা এবং ধর্ম-সংস্কৃতির ওপর চলে বেপরোয়া ও নির্মম হামলা। উচ্চবিত্ত ও অভিজাতদের মধ্যে অনেকেই মরল, কিছু পালিয়ে বাঁচল, আর যারা মাটি কামড়ে টিকে রইলো তারা ত্রাসের মধ্যেই দিন রজনী গুণে গুণে রইল। কাজেই ধন, জন আর প্রাণের নিরাপত্তা যেখানে অনুপস্থিত, যেখানে প্রাণ নিয়ে সর্বক্ষণ টানাটানি, সেখানে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার বিলাস অসম্ভব। ফলে সে সময়ে সাহিত্য সংস্কৃতির উন্মেষ বিকাশের প্রশ্নই উঠেনা।’ ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলমানদের সম্পর্কে লিখেছেন ‘শারীরিক বল, সমরকুশলতা ও বীভৎস হিংস্রতার দ্বারা বাংলা ও তাহার চতুস্পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ইসলামের অর্ধচন্দ্র খচিত পতাকা প্রোথিত হইল। ১৩শ হইতে ১৫শ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত প্রায় দুই শত বছর ধরিয়া এই অমানুষিক বর্বরতা রাষ্ট্রকে অধিকার করিয়াছিল, এই যুগ বঙ্গসংস্কৃতির তামসযুগ, য়ুরোপের মধ্যযুগ এর সহিত সমতুলিত হইতে পারে।’ ড. সুকুমার সেনের মতে ‘মুসলমান অভিযানে দেশের আক্রান্ত অংশে বিপর্যয় শুরু হয়েছিল।’ গোপাল হালদারের মতে তখন ‘বাংলার জীবন ও সংস্কৃতি তুর্ক আঘাতে ও সংঘাতে, ধ্বংসে ও অরাজকতায় মূর্ছিত অবসন্ন হয়েছিল। খুব সম্ভব সে সময়ে কেউ কিছু সৃষ্টি করবার মত প্রেরণা পায়নি।’

কিন্তু দেখা দরকার বখতিয়ারের আগমনে আসলেই কি বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগের সৃষ্টি হয়েছিল কিনা বা এ যুগের কোন সাহিত্য পাওয়া যায় কিনা? বখতিয়ার খিলজী এদেশে আসেন ১২০৪ সালে আর মূলত মুসলমানগণ এদেশে আসতে শুরু করে অষ্টম শতাব্দী থেকেই। ইসলাম প্রচারকগণ ইসলাম প্রচারের জন্য আর আরব বণিকগণ ব্যবসার উদ্দেশ্যে এদেশে আসে। এদেশে নিম্নবর্গীয় হিন্দু এবং নির্যাতিত বৌদ্ধ ইসলামের সুমহান আদর্শ দেখে তখন থেকেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়া শুরু করে। বখতিয়ার যখন এদেশে আসে তখন কোন যুদ্ধ করতে হয়নি। মুসলিম সেনা রাজ্যে প্রবেশ করেছে এ খবর শুনে লক্ষণ সেন পিছনের দরজা দিয়ে একা পালিয়ে যায়। বখতিয়ার খিলজী মাত্র ১৭ জন সাথী নিয়ে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন। কোনরূপ সংঘর্ষ বা রক্তপাত হয়নি। বখতিয়ার এসে কাউকে রাজ্য থেকে বের করেও দেয়নি বরং মুসলমানগণ এদেশে মাতৃভাষার চর্চার ব্যপারে উৎসাহ দেয় এবং কবি সাহিত্যিকদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। যার প্রমাণ লক্ষণ সেনের সভাকবি জয়দেব এবং হলয়ুদ মিশ্রকে বখতিয়ার তাঁর সভাকবি হিসেবে রেখে দেন এবং ১২০১-১৩৫০ খ্রি এর মধ্যে যে সমস্ত সাহিত্যকর্ম রচিত হয় তার মাঝে উল্লেখযোগ্য রামাই পণ্ডিতের “শূন্য পুরাণ”, জয়দেবের শ্রেষ্ঠ কীর্তি “গীতগোবিন্দ” এবং মুসলমানদের শাসকদের প্রশংসা কীর্তন গেয়ে হলয়ুদ মিশ্র “শেখ শুভদোয়া” কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন।


প্রকৃতপক্ষে মুসলিম শাসনামলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নবজন্ম ঘটে। মুসলিম আমলের পূর্বে বাংলা সাহিত্যের শুধুমাত্র চর্যাপদ ছাড়া অন্য কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। ড. সুনীতিকুমার ও সুকুমার সেনরা সত্য আড়াল করেছে কিন্তু ড. দীনেশ চন্দ্র কিছুটা ইতস্তত করেও স্বীকার করেছে যে ‘হিন্দু নৃপতিগণ নয়, মুসলমান সুলতানগণই মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্চায় উৎসাহ প্রদান করেছেন (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য- পৃঃ ৭৩)। ড. ওয়াকিল আহমেদ বলেন- “বাংলা সাহিত্যে কথিত ‘অন্ধকার যুগ’ মোটেই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের যুগ ছিল না। ধর্ম-শিক্ষা শিল্প চর্চার দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত ছিল, তারা সীমিত আকারে হলেও শিক্ষা সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন।“ (বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্ত, পৃ-১০৫)। বিশিষ্ট গবেষক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান “বাংলার সামাজিক ও সংস্কৃতির ইতিহাস” গ্রন্থের ভূমিকায় বলেন “যদি বাংলায় মুসলিম বিজয় ত্বরান্বিত না হতো এবং এদেশে আরো কয়েক শতকের জন্য হিন্দু শাসন অব্যাহত থাকতো, তবে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেত এবং অবহেলিত ও বিস্মৃত-প্রায় হয়ে অতীতের গর্ভে নিমজ্জিত হতো।“


মুসলিম শাসনামলে বাংলা সাহিত্যে নবপ্রাণ সঞ্চারিত হয়। এ যুগে মৌলিক সাহিত্য ও অনুবাদ সাহিত্য উভয় শাখায় কাজ হয়। মৌলিক সাহিত্যের মাঝে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, পুথি সাহিত্য, লোকসাহিত্য, জঙ্গনামা সাহিত্য, মার্সিয়া সাহিত্য, কবিগান, নাথ সাহিত্য প্রভৃতি রচিত হয়। অনুবাদ সাহিত্যে মুসলিম সুলতানগণের আদেশে সংস্কৃত থেকে রামায়ণ, মহাভারত, ভগবত বাংলায় অনুবাদ হয় এবং আরবী ও ফার্সী সাহিত্য থেকে মুসলমান কবিগণ অসংখ্য রোমান্টিক প্রণয় উপাখ্যান বাংলায় অনুবাদ করেন।

মধ্যযুগীয় সাহিত্যে হিন্দু কবিদের কাব্যে তাদের ধর্ম, দেব-দেবী ও পৌরাণিক কাহিনীতে ভরপুর। মানবিক আবেদন সেখানে ছিল না বললেই চলে।অবশ্য রাধা-কৃষ্ণের পরকীয়া প্রেম, ষোল শো গোপিনীর সাথে শ্রীকৃষ্ণের অবৈধ প্রণয়লীলা, মঙ্গলকাব্য ও অন্যান্য সাহিত্যের অসংখ্য কাহিনিতে অশ্লীলতা, নগ্নতা, ব্যভিচার ও অনৈতিকতা কিছু মানবীয় কাহিনী এতো প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে যে কোন রুচিশীল পাঠকই তা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। আর বৈষ্ণব সাহিত্য, মঙ্গলকাব্যে সব একি কাহিনী বারবার আলোচনা হতে হতে একটা চরম বিরক্তিকর একঘেয়েমিতে ভরে উঠেছিলো মধ্যযুগীয় সাহিত্য ঠিক এমনি সময়ে মুসলমান কবি-সাহিত্যিকগণ কুরআন-হাদীস, নবী-রাসূল, ইসলামের ইতিহাস ও মানবিক ইসলামি ভাব-সম্পদ তো আছেই উপরন্তু মানবিক সংবেদনা, প্রেম-প্রণয়, জীবনের আর্তি মানবিক রসে জারিত করে হৃদয়গ্রাহীভাবে সাহিত্য ফুটিয়ে তুলেছেন। এ প্রসঙ্গে ড. আহমদ শরীফ তাঁর “বাঙালী ও বাংলা সাহিত্য”, ড এম এ রহীম তাঁর “বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস”, নাজিরুল ইসলাম তাঁর “বাংলা সাহিত্যের নতুন ইতিহাস”, প্রভৃতি গ্রন্থে নিজস্ব ভাষায় বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। মধ্যযুগের উল্লেখযোগ্য মুসলিম কবি হলেন- শাহ মোহাম্মদ সগীর, আব্দুল হাকীম, ফকীর গরীবুল্লাহ, ফকীর মুহাম্মদ, দৌলত উজির, বাহরাম খাঁ, শেখ ফয়জুল্লাহ, আলাউল, মাগন ঠাকুর, মুহাম্মদ কবির প্রভৃতি।


মধ্যযুগীয় কাব্যসাহিত্যে পয়ার ছন্দের ব্যবহার সব কবিরাই করেছেন এবং ভাষা, বিষয়বস্তু, ভাবানুভূতি বা অনুপ্রেরণা, আঙ্গিক ও প্রকরণগত বিভিন্ন দিকে আমাদের সাহিত্য একটি প্রাণময়, দীপ্তিময়, ঐশ্বর্যমণ্ডিত ধারা গড়ে উঠেছে তা মূলত আরবী-ফারসী সাহিত্য প্রভাবিত হয়ে। আরবী ভাষায় আল্লাহ তায়ালার নাযিলকৃত মহাগ্রন্থ আল-কুরআন কেবল মানব জাতির জীবন বিধানই নয়, এর শব্দ বিন্যাস, বাক্য গঠন প্রণালী, তাৎপর্যপূর্ণ প্রয়োগ-বিধি, উপমা, ছন্দ, বিশিষ্টাত্মক শব্দ, অর্থ, লালিত্য ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে এক অনন্য গ্রন্থ। যেহেতু এটি বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহর সৃষ্টি তাই এর রুপ-সৌন্দর্য ও অন্যান্য বৈশিষ্ট পৃথিবীর অন্য কোন গ্রন্থের সাথে তুলনা করাও ধৃষ্টতা মাত্র। আর মুসলমানগণ ইসলাম প্রচার, রাজ্য জয়, ব্যবসা-বাণিজ্য বা যে উদ্দেশ্যেই পৃথিবীর যে কোন দেশে গেছে, সেখানেই এই গ্রন্থটি সাথে নিয়ে গেছে, ফলে সেখানকার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনাচারের উপর এ গ্রন্থের অনিবার্য প্রভাব অবশ্যই কম-বেশি পড়েছে। আল-কুরআনের সাথে সাথে আরবি, ফার্সি, তুর্কি, উর্দু প্রভৃতি ভাষার বিশ্ববরেণ্য অসংখ্য কবি ও তাদের অমর সাহিত্যের প্রভাবও বাংলা সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে ও বাংলা সাহিত্য তার আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক ভাবধারা ও ঐশ্বর্য-সম্পদে সুসমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

ভুলে যাওয়া ইতিহাস

ঘটনা প্রবাহ ১৭৫৭-১৯৪৭

 ১৭৫৭ ॥ ২৩ জুন : পলাশীর যুদ্ধ : পলাশীর যুদ্ধে প্রহসন, বিশ্বাসঘাতকতা এবং ছলচাতুরির মাধ্যমে নবাব সিরাজ-উদ- দৌলাকে পরাজিত করে ইংরেজ শাসকরা ভারতে তাদের সাম্রাজ্যের সূচনা করে। শুরু হয় ভারতীয় উপমহাদেশে দীর্ঘ প্রায় দু'শ' বছরের পরাধীনতার ইতিহাস। পাশাপাশি ইংরেজ প্রভুত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামেরও ইতিহাস।

১৭৬০ ॥ বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরকে সরিয়ে ইংরেজরা মীর কাশিমকে ক্ষমতহায় বসায়। স্বাধীনচেতা মীর কাশিমই প্রতিরোধের প্রথম মশাল জ্বালালেন। গদিতে বসেই তিনি দেখলেন যে, বাংলা সুবার কৃষক সমাজ, তাঁতী, বণিক সবাই বোফানির ইংরেজ কর্মচারীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। কলবাতায় ইংরেজ বড়কর্তা জানকিটার্টকে এক চিঠিতে তিনি লিখলেন: ‘তোমাদের কর্মচারীরা চাষী ও বণিকদের কাছ থেকে জোরজবরদস্তি করে জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। হয় দাম দেয় না, নয়তো যা দাম তার মাত্র সিকিভাগ দেয়। তোমাদের গোমস্তরা ব্যবহার করে যেন তারাই জমিদার, তালুকদার বা মালিক।" ফলে নবাবের সঙ্গে বিরোধ যুদ্ধে পরিণত হলো।

১৭৬৪ ॥ বকঘারের যুদ্ধে মীর কাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজাউদ-দৌলা ও দিল্লীর পলাতক বাদশাহ শাহ্ আলমের সেনাদল পরাজিত হলো ইংরেজদের কাছে। নতি স্বীকার করলেন নবাব ও বাদশাহ্। কিন্তু হার মানলেন না মীর কাশিম। পলাতক অবস্থায় ১৭৭৭ সালে মারা যান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই পরাজিত মহান সৈনিক।

১৭৬৫ ॥ ১২ অক্টোবর গভর্নর ক্লাইভ সম্রাট দ্বিতীয় শাহ্ আলমের হাত থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি সনদের ফরমান লাভ করেন। অর্থাৎ সম্রাট শাহ আলমকে বছরে ২৬ লাখ টাকা দানের পরিবর্তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পেয়ে গেল বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের অধিকার। এ বছরই মীর কাশিমের স্থলাভিষিক্ত মীরজাফরের পুত্র নাজমুদুল্লাহর কাছ থেকে তারা প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের অধিকারও কেড়ে নেয়।

১৭৬৯-৭০ ॥ (বাংলা ১১৭৬) ছিয়াত্তরের মন্বন্তর : বাংলা ও বাংলা সন্নিহিত প্রদেশগুলোর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায়। আনন্দমঠে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন- "লোকে প্রথম ভিক্ষা করিতে লাগিল। তারপর কে ভিক্ষা দেয়। .....গরু বেচিল, লাঙ্গল বেচিল, জোতজমা বেচিল। তারপর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করি। তারপর স্ত্রী বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী কে কেনে?... খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল। ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল। আগাছা খাইতে লাগিল। ইকর ও বন্যেরা কুকুর, ইঁদুর ও বিড়াল খাইতে লাগিল। অনেকে পালাইল, যাহারা পালাল না তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল।"
কিন্তু সে বছরও (১৭৭১) ইংরেজের নীট রাজস্ব আদায় পূর্ববর্তী ষোল আনা ফসল জন্মানোর বছরের আদায়কেও ছাড়িয়ে যায়।

১৮০০॥ সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ : ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় ইংরেজ শাসক ও তাদের রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে উত্তরবঙ্গের গরীব হিন্দু-মুসলমান চাষীরা বিদ্রোহ করেছিল। প্রায় তিন দশক ধরে এ বিদ্রোহ চলে। তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সন্ন্যাসী ও ফকিরেরা। তাদের নেতাদের মাঝে প্রধান ছিলেন মজনু শাহ্ ও ভবানী পাঠক। বহুগ্রাম জ্বালিয়ে, নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিচারে বহু গ্রামবাসীকে হত্যা করে এক দশক পরে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয় ইংরেজরা।

১৭৯৮-৯৯ ॥ মেদিনীপুর ও বাঁচুড়ার চুয়াড় বিদ্রোহ : মেদিনীপুর, বাঁচুড়া ও মানভূমের জঙ্গলমহলের অধিবাসী আদিম ও অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের স্থানীয় জমিদারশ্রেণী অবজ্ঞাভরে চুয়ার্ড নাম দিয়েছিল। তাদের জমি কেড়ে নেয়ায় বা সাধ্যাতীত মাত্রায় নতুন কর ধার্য করায় বিদ্রোহ দেখা দেয়। ওয়ারেন হেস্টিংস ব্যর্থ হন এ বিদ্রোহ দমনে। ১৭৯৯ সালে বড়লাট ওয়েলেসলি চুয়াড় বিদ্রোহের নেতাদের ফাঁসি দিয়ে বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনেন।

১৭৯৩॥ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে বড়লাট কর্নওয়ালিস সমগ্র বাংলা প্রেসিডেন্সিতে প্রবর্তন করলেন নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। মেহনতী চাষীর সর্বনাশ হলো এবং এক ধরনের ভূঁইফোড় জমিদার গোষ্ঠীর জন্ম হলো। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখা দিলো সর্বত্র।

১৭৯৯ ॥ টিপু সুলতানের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম : দক্ষিণ ভারতে ইংরেজের সাম্রাজ্য বিস্তারের পথে প্রধান বাধা ছিলেন হায়দার আলী ও তার ছেলে টিপু। ইংরেজের শত্রু ফরাসীদের সাহায্যে টিপু আধুনিক অর্থনীতি ও সেনাবাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। তাই আর দেরি না করে বড়লাট ওয়েলেসলি বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে টিপুর রাজ্য আক্রমণ করেন। এক সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতায় রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তনের দখল নেয় ইংরেজ সৈন্য আর বীরের মতো লড়তে লড়তে রণক্ষেত্রে প্রাণ দেন টিপু।

১৭৯৯-১৮০১ ॥ পলিগার বিদ্রোহ : বর্তমান তামিলনাড়-র টিনেডেলি অঞ্চলের পলিগাররা ছিলেন সামন্ত জমিদার যারা আটটের নবাবের আধিপত্য স্বীকার করলেও প্রায় স্বাধীন রাজার মতো চলতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাবের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে পলিগাররা বিদ্রোহ করে। এদের মাঝে অগ্রণী ছিলেন পাঞ্জালাল কুরিচির পলিগার বীর পাঞ্জেম কাট্টাবোখান। ১৭৯৯ সালের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান এবং বিশ্বাসঘাতকতার ফলে কিছুদিনের মধ্যে ধরা পড়েন। তার ফাঁসি হয়। কাট্টাবোখান নিহত হলেও কিন্তু যুদ্ধ থামেনি।

১৮১৭-২৫॥ উড়িষ্যার পাঠক অভ্যুত্থান : রাজারা পাঠকদের মাইনে দিতেন না-তবে জীবিকা নির্বাহের জন্যে তাদের ‘চাকরান' জমি দেয়া হতো। ইংরেজ ঐ রাজাদের একে একে ক্ষমতাচ্যুত করার সঙ্গে সঙ্গে পাইকদের ‘চাকরান' জমিও কেড়ে নিল। এর বিরুদ্ধে পুরীর বকসী জগবন্ধুর নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়। বিদ্রোহ দমনে বিশাল ইংরেজ বাহিনী পুরী দখল করেÑ জগবন্ধু জঙ্গলে পালিয়ে যান।

১৮২৪-৩০ ॥ কিট্টরের রানী চান্নাম্মা ও সাঙ্গোলির রায়ান্নার সংগ্রাম : কর্ণাটকের বেল গাঁওয়ের কাছেই ছোট্ট বিক্টর রাজ্যের অপুত্রক রাজার মৃত্যু হলে ইংরেজরা রাজ্যটি আত্মসাৎ করার চেষ্টা করে। বাধা দেন বিধবা রানী চান্নাম্মা। ১৮২৫-এ শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম। অসম যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও বন্দী হন এবং কারাগারেই তার মৃত্যু হয়। কিন্তু প্রতিরোধ থামে না। বিদ্রোহের মশাল হাতে এগিয়ে আসেন সাঙ্গোলির চাষীর ছেলে রায়ান্না। ১৮৩০ সালের এপ্রিলে এংরেজ ফৌজ রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দেয় প্রতিরোধ সংগ্রাম-ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে রায়ান্নাকে।

১৮২৪-২৫॥ বিদ্রোহ দিকে দিকে : মধ্যভারতের বুন্দেলখ- ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে মুসলমান ও হিন্দু গরীব চাষীরা বিদ্রোহ করে। একই ধরনের বিদ্রোহে ফেটে পড়ে বর্তমান হরিয়ানার রোহতাক ও হিযাব জেলার জাঠ চাষীরা ১৮২৪ সালে। ১৮৩৯ থেকে ১৮৪৫ সাল পর্যন্ত সমগ্র গুজরাটে সংঘটিত হয় বোল বিদ্রোহ। ১৮৪৫ সালে মহারাষ্ট্রের সামন্তওয়াড়ি ও কোলাপুরে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৮২৯-৩৩ সালে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের মেঘালয়ের অধিবাসীরা সংঘটিত করে খাসী বিদ্রোহ। তেমনই ১৮৩০ থেকে ১৮৩৩ পর্যন্ত ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ উপজাতি অঞ্চল জুড়ে দেখা দেয় আদিবাসী বিদ্রোহ। রাঁচী থেকে মালভূমি পর্যন্ত লাখ লাখ মুন্ডা ও হো এই বিদ্রোহে অংশ নেয়।

১৮৫৫ ॥ সাঁওতাল বিদ্রোহ : সিধু, কানু, ভৈরব প্রমুখের নেতৃত্বে হাজার হাজার সাঁওতাল ইংরেজ শাসনের অবসান ও স্বাধীন সাঁওতাল রাজত্ব প্রতিষ্ঠার সংকল্পে কলকাতা মার্চ করে। সংঘর্ষে ২৩ হাজার সাঁওতালকে হত্যা করে ইংরেজরা।

১৭৭১-১৮৩১॥ ওয়াহাবি আন্দোলন : ইংরেজ রাজত্বের প্রথম একশ' বছরে ভিন্ন ধরনের প্রতিরোধ সংগ্রাম ওয়াহাবি ও ফরাজী আন্দোলন। ওয়াহাবিদের নেতা বেরিলির সৈয়দ আহমদ (১৭৮৬-১৮৩১)-এর প্রচারের মূল কথা ছিল। ভারতবর্ষ এখন শত্রুর দেশে পরিণত হয়েছে। ইংরেজরাই ভারতের স্বাধীনতার শত্রু এবং সমস্ত ওয়াহাবিরই কর্তব্য হলোÑ এই বিদেশী শাসনের উচ্ছেদ ঘটানো। বাংলা অঞ্চলেও ওয়াহাবি বিদ্রোহের ঢেউ লেগেছিল। বারাসাতের স্বরূপনগর ও বাদুড়িয়া অঞ্চলে এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন মীর নেসার আলী তিতুমীর। তিনি এক বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন। যুদ্ধে তিমুমীরসহ ৪০ জন প্রাণ দিলেন। প্রাণদ- হলো তিতুর সেনাপতি গোলাম মাসুমের, বাকিদের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। আন্দামানে বন্দী হিসেবে প্রথম চালান হয় ওয়াহাবিরাই।

১৮৪২॥ ফরাজি আন্দোলন : ওয়াহাবি আন্দোলনেরই সমগোত্রীয় ছিল ফরাজি আন্দোলন। "পৃথিবীর সমস্ত জমির মালিক আল্লাহ। তাঁর চোখে সবাই সমান। কাজেই তাঁকে যদি মান্য করি, তবে জমিদারদের খাজনা দেবো না, নীলকর সাহেবদের নীল বুনব না, বিদেশী ফিরিঙ্গিদের রাজত্ব মানবো না"- ১৮৪২ সালে এ ঘোষণা দিলেন ফরাজি আন্দোলনের নেতা দুদু মিয়া। ফরিদপুরের মাদারীপুরে তার জন্ম, আসল নাম মুহাম্মদ সোহাইল। দুদু মিয়া সমস্ত বাংলাদেশকে অনেকগুলো অঞ্চল বা হাল্কায় ভাগ করেন। প্রতিটি হাল্কাতে ৩০০ থেকে ৫০০ ফরাজি পরিবার বাস করত। প্রতিটি হাল্কার মাথার ওপরে থাকতেন একজন সংগঠক, তাকে বলা হতো ওস্তাদ। সারা বাংলাদেশে এ রকম কয়েক হাজার ওস্তাদ ছিলেন, আর তাদের মাথার ওপর ছিলেন দুদু মিয়া। ফরাজি আন্দোলন মাদারীপুর থেকে প্রথমে বাকেরগঞ্জে, তারপর একদিকে ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ অপরদিকে যশোর ও ২৪ পরগণা জেলায় প্রসার লাভ করে। নীলকর সাহেব, দেশী জমিদার ও ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। বহু ফরাজি গ্রেফতার হলেন, কারারুদ্ধ হলেন দুদু মিয়া। জেলের মধ্যে ১৮৬২ সালে তার মৃত্যু হয়। তবে একটা কথা। ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন প্রধানত মুসলমানদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকার ফলে এর একটা ধর্মীয় সীমাবদ্ধতার দিকও ছিল। আর এ সুযোগটাই নিয়েছিল ইংরেজ শাসকবর্গ। বলাই বাহুল্য।
ইংরেজ রাজত্বের প্রথম একশ' বছরের ইতিহাস এমনই অজস্র ছোট-বড় বিদ্রোহে ভরা।

১৮৫৭ ॥ সিপাহী বিদ্রোহ : ১৮৫৭-এর মে মাসে প্রথমে মীরাটের ছাউনিতে। পরে দিল্লীতে দেখা দিলো সিপাহীদের ব্যাপক বিদ্রোহ। এ বছরেরই ২৯ মার্চ ব্যারাকপুরের ছাউনিতে বিদ্রোহের নিশান উড়িয়ে দেন তরুণ সিপাহী মঙ্গল পান্ডে। প্রাণ দেন ফাঁসিকাষ্ঠে। দিল্লীতে বিদ্রোহী সিপাহীদের প্রচারপত্রে লেখা হলো: ইংরেজ শাসনে আমাদের দেশ স্বাধীনতা হারিয়েছে। জনসাধারণ দরিদ্র ও সর্বস্বান্ত। করভারে তারা জর্জরিত। খাদ্য ও বস্ত্রের নিদারুণ অভাব, মেয়েদের ইজ্জত পর্যন্ত বিপন্ন। ইংরেজদের অত্যাচারের কোনও সীমা নেই। দাসত্বের এই অপমান। এই যন্ত্রণা ভারতবাসী আর কতদিন সহ্য করবে? ৯ মে মিরাটের ছাউনিতে বিদ্রোহ শুরু হয়। ১১ মে বিদ্রোহী সিপাহীরা দিল্লী দখল করে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে স্বাধীন ভারতের বাদশাহ বলে ঘোষণা করেন। ৩০ মে বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে ওঠে লক্ষেèৗতে, সমগ্র আওয়াদ অঞ্চলে। ৪ জুন বিদ্রোহ হয় কানপুরে। ক্রমে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে শতদ্রু নদীর দক্ষিণ থেকে বিহার পর্যন্ত। উত্তর প্রদেশ থেকে মধ্যভারত পর্যন্ত সমগ্র হিন্দি উর্দুভাষী বিরাট অঞ্চলে। সমগ্র ভারত হয়ে ওঠে অশান্ত। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রজ্যের ভিত টলে ওঠে।
১৮৫৭-র বিদ্রোহের মুখপত্র ছিল পায়াম-এ আজাদী পত্রিকা। তার এক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, "ইংরেজ শাসকরা চেষ্টা করবে হিন্দু ও মুসলমানদের পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে। ভাইসব। তাদের শয়তানির ফাঁদে কেউ পা দেবেন না। হিন্দুরা, মুসলমানরা, ভাইরা, সমস্ত তুচ্ছ ভেদাভেদ ভুলে স্বাধীনতার যুদ্ধে একই পতাকার নীচে ঐক্যবদ্ধ হোন।"
ইংরেজ সাম্রজ্যবাদীরা ভারতের এই স্বাধীনতা বিদ্রোহকে দমন করে নৃশংসতার সঙ্গে। কামানের মুখে হাজার হাজার সিপাহীকে বেঁধে তারপর কামান দেগে বীভৎসভাবে হত্যা করা হলো তাদের। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিলো ইংরেজরা। সমগ্র উত্তর ও মধ্যভারত জুড়ে নির্বিচারে চলল হত্যাকান্ড।

১৮৫৯-৬০ ॥ নীল বিদ্রোহ : বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে দেখা দেয় নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ ‘নীল বিদ্রোহ' নামেই পরিচিত। নীলকর সাহেবদের বর্বর অত্যাচারের প্রেক্ষাপটে দীনবন্ধু মিত্র লিখলেন-‘নীল দর্পণ' নাটক। যশোরে ১৮৩০তে ও পরে ১৮৮৯-৯০তে বিহারের দ্বারভাঙ্গা ও চকারণে ১৮৬৬-৬৮ পর্যন্ত চললো নীল বিদ্রোহ।

১৮৭২ ॥ কুকা বিদ্রোহ : ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকে পাঞ্জাবের দেশপ্রেমিক শিখরা সংঘটিত করেন কুকা বিদ্রোহ। ১৮৭২ এ ইংরেজ ফৌজ প্রবল অত্যাচার করে বহু গ্রাম জ্বালিয়ে দমন করে কুকা বিদ্রোহ। বিদ্রোহের নেতা রাম সিং রেঙ্গুনে নির্বাসনে প্রাণত্যাগ করেন ১৮৮৫ সালে।