সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদান (১ম কিস্তি)

[‘মক্তব’ পাঠচক্রের ১৩তম পর্বে এই বিষয়ে আলোচনা হয়। বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদানকে সঠিকভাবে পাঠ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি থেকেই এই বিষয়কে বাছাই করা হয়েছিল। আলোচনার সংক্ষিপ্তসার নিয়েই এই লেখাটি প্রস্তুত করা হলো।]

বর্তমান সময়ে এসে বাংলা সাহিত্যে ‘মুসলিম অবদান’ আলোচনা করা কেন এতো দরকার? 
 এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়- অতীত ইতিহাস একটি জাতির প্রাণ এবং সাহিত্য হলো জাতির দর্পণ। বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বোঝার ক্ষেত্রেও এ ভাষায় সাহিত্যের ঐতিহাসিক ধারাটা জানা জরুরি। বর্তমান সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদানকে অস্বীকার করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। মুসলিম অবদান অস্বীকার নাকি মুসলিম অবদানের শূণ্যতা- এই প্রশ্নকে সামনে রেখেই বর্তমান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলায় বিশেষভাবে বাংলা সাহিত্যে ‘মুসলিম অবদান’ পাঠ জরুরী।

দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি সম্মুখে আসে সেটি হলো- আমরা এই ইতিহাস কিভাবে পড়বো? 
 জবাব হচ্ছে- বাজারে অনেক ইতিহাস প্রচলিত আছে যেগুলোতে ইতিহাসের বিকৃতি লক্ষ্যণীয়। তৎকালীন সাহিত্যের ধারায় মুসলিমদের যে অবদান, তা তৎকালীন সমাজের সামাজিক, রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে খুবই প্রাসঙ্গিক। তখনকার শাসকদের ধর্মীয় পরিচয় ভিন্ন থাকায় পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিকগন স্বধর্মপ্রীতির কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সত্যের অপলাপ ঘটিয়েছেন। যার ফলে বিভিন্ন পর্যায়ে মুসলিম অবদানকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই_ প্রকৃত সত্যের আলোকে এই ইতিহাস পড়া জরুরি।

বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করলে প্রথমেই প্রশ্ন আসে- বাংলা ভাষা ও সাহিত্য কি? ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করা খুবই দূরহ ব্যাপার। কারণ, ভাষা দিয়েই অন্য সবকিছু সংজ্ঞায়িত করা হয়। ভাষা মনের ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যম। পৃথিবীতে প্রায় চার হাজার ভাষা রয়েছে। ভাষাভাষী জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলা ভাষা পৃথিবীতে চতুর্থ। পৃথীবির অন্যান্য ভাষা তার বৈশিষ্টের কারণে নামকরন করা হয়েছে কিন্তু বাংলা ভাষা স্থানের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যই বাংলা সাহিত্য। সাহিত্য একটা লিখিত কর্ম, যা কবি বা সাহিত্যিকদের দ্বারা রচিত হয়।

এই আলোচনায় বাংলা ভাষার ইতিহাস জানাও খুবই জরুরি। ভাষা কোন প্রাণীর মতো নয় যে বলা যাবে অমুক বছর, অমুক মাস, অমুক দিন, এতোটায় জন্ম লাভ করেছে! ভাষা একটি চলমান নদীর মতো। নদী যেমন এঁকেবেকে চলে, বিভিন্ন শাখা প্রশাখা বের হয় ঠিক তেমনি ভাষাও বিকৃত হয়ে বিভিন্ন ভাষার জন্ম দেয়। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে উপমহাদেশে জনবসতি শুরু হয়। চীন থেকে অনার্যগণ এ দেশে এসে বসবাস শুরু করে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ২০০০ বছর পূর্বে উপমহাদেশে আর্যগণ আসে ইরান ও বলকান অঞ্চল থেকে। তাঁদের মাঝে যে ভাষাগোষ্ঠীর জন্ম হয় তা হলো ইন্দোইউরোপীয় ভাষা। “ইন্দোইউরোপীয় ভাষার ‘শতম’ শাখা থেকে ইন্দো ইরানীয় হয়ে প্রাচীন ভারতীয় আর্য থেকে ইন্দো আর্য হয়ে গৌড়িয় প্রাকৃত হয়ে বঙ্গকামরুপী থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়।“ বাংলা ভাষার জন্ম ৭ম শতাব্দীতে পাল আমলে এবং লিখিত রুপ চালু হয় তখন থেকেই। তখনকার প্রাপ্ত একমাত্র গ্রন্থ চর্যাপদ।


বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগঃ
 
 • ৬৫০-১২০০ খ্রি প্রাচীন যুগ।
 • ১২০১-১৮০০ খ্রি মধ্যযুগ।
 • ১৮০১- বর্তমান আধুনিক যুগ।
এই বঙ্গে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ করা হয়। বাংলা ভাষার জন্ম থেকে বখতিয়ার খিলজীর আগমন পর্যন্ত প্রাচীন যুগ, বখতিয়ারের আগমন থেকে মধ্যযুগ এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আধুনিক যুগের সূচনা। এর মাঝে আরেকটা যুগের অবতারনা ঘটানো হয়েছে ১২০১-১৩৫০খ্রি পর্যন্ত অন্ধকার যুগ নামে। এখন আমরা দেখব এই অন্ধকার যুগের অস্তিত্ব আদৌ আছে কিনা আর যদি থেকেই থাকে তাহলে সেটা কোন আমলে? আসলেই কি এ যুগে কোন সাহিত্য রচনা হয়নি?

ইতিহাসের আলোকে পাঠ করলে আমরা জানতে পারি – বৌদ্ধ শাসক পাল বংশের (৬৫০-১১২৫ খ্রি) আমলে বাংলা ভাষার জন্ম এবং এ ভাষার একমাত্র প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ এ যুগেই রচিত। এরপর বিজয় সেন ক্ষমতা দখল করে ১০৯৭খ্রিষ্টাব্দে। ব্রাহ্মণ সেন বংশ ‘কৌলিন্য’ প্রথার প্রচলন করে, বৌদ্ধদের উপর নির্মম নির্যাতন-অত্যাচার চালায়। ফলে, বৌদ্ধ সহজিয়াগণ প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাংলার সমতল ভূমি ছেড়ে নেপালে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং সেনরা বাংলা ভাষার টুটি চেপে ধরে, রাজ্যে সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ঘটায়। তাদের নিয়মানুযায়ী ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য কেউ সংস্কৃত ভাষা পড়তে পারত না এবং নিজ ভাষায় তাদের ধর্মগ্রন্থ বুঝবার অধিকারও কারও ছিলো না। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগ্ণ ফতোয়া দিলো – ‘নম্লেচ্ছ ভাষা শিক্ষেত’, ‘অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ। ভাষায়াং মানবঃশ্রত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ’ কিংবা বাংলা ভাষায় যারা ধর্মগ্রন্থ পড়বে তারা রৌরব নামক নরকে জ্বলবে প্রভৃতি। সমগ্র বাংলায় মারাত্মক নৈরাজ্য শুরু হয়ে যায়। আর বিশৃঙ্খল অবস্থায় কখনও সাহিত্য চর্চা সম্ভব নয় এবং হয়ও না। মূলত এই সময়ে বাংলা সাহিত্যে বিশাল শূন্যতা্র সৃষ্টি হয়। অথচ হিন্দু ঐতিহাসিকরা সেনদের অত্যাচারের ফলে যে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয় এটাকে তারা মুসলিম শাসকদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। 

আসলে কাগজের উপর লেখা সুন্দর হবে শুধু কাগজ পরিষ্কার থাকলেই নয় বরং মগজ পরিষ্কার থাকলে তবেই। অথচ মগজে বেশির ভাগ ইংরেজ পঙ্কিল, পক্ষপাতিত্ব ও অনেকের যোগ্যতার অভাব অস্বীকার করা যায় না। আসলে একফোঁটা কলমের কালি একটা এটোম বোমার চেয়েও ক্ষতিকর, যদি তা ভুল পথে ব্যবহৃত হয়।

বিনা বাঁধায় এবং রক্তপাতহীন অবস্থায় নদীয়া বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলমান শাসনের সূচনা হওয়ার পর সেখানে হত্যাযজ্ঞ, হামলা, আগ্রাসন, ধ্বংসযজ্ঞ এসব কেবল কল্পনায়ই হতে পারে এবং নিন্দুকেরাই তার প্রচার কাজে যুক্ত থাকতে পারে। এ সময় বিজাতীয় মনোভাবাপন্ন ইতিহাসকারেরা মনে করেছেন মধ্যযুগের ‘দেড়’শ, দু’শ কিংবা আড়াই’শ বছর ধরে হত্যাকাণ্ড ও অত্যাচার চালানো হয় কাফেরদের ওপর। তাদের জীবন জীবিকা এবং ধর্ম-সংস্কৃতির ওপর চলে বেপরোয়া ও নির্মম হামলা। উচ্চবিত্ত ও অভিজাতদের মধ্যে অনেকেই মরল, কিছু পালিয়ে বাঁচল, আর যারা মাটি কামড়ে টিকে রইলো তারা ত্রাসের মধ্যেই দিন রজনী গুণে গুণে রইল। কাজেই ধন, জন আর প্রাণের নিরাপত্তা যেখানে অনুপস্থিত, যেখানে প্রাণ নিয়ে সর্বক্ষণ টানাটানি, সেখানে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার বিলাস অসম্ভব। ফলে সে সময়ে সাহিত্য সংস্কৃতির উন্মেষ বিকাশের প্রশ্নই উঠেনা।’ ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলমানদের সম্পর্কে লিখেছেন ‘শারীরিক বল, সমরকুশলতা ও বীভৎস হিংস্রতার দ্বারা বাংলা ও তাহার চতুস্পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ইসলামের অর্ধচন্দ্র খচিত পতাকা প্রোথিত হইল। ১৩শ হইতে ১৫শ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত প্রায় দুই শত বছর ধরিয়া এই অমানুষিক বর্বরতা রাষ্ট্রকে অধিকার করিয়াছিল, এই যুগ বঙ্গসংস্কৃতির তামসযুগ, য়ুরোপের মধ্যযুগ এর সহিত সমতুলিত হইতে পারে।’ ড. সুকুমার সেনের মতে ‘মুসলমান অভিযানে দেশের আক্রান্ত অংশে বিপর্যয় শুরু হয়েছিল।’ গোপাল হালদারের মতে তখন ‘বাংলার জীবন ও সংস্কৃতি তুর্ক আঘাতে ও সংঘাতে, ধ্বংসে ও অরাজকতায় মূর্ছিত অবসন্ন হয়েছিল। খুব সম্ভব সে সময়ে কেউ কিছু সৃষ্টি করবার মত প্রেরণা পায়নি।’

কিন্তু দেখা দরকার বখতিয়ারের আগমনে আসলেই কি বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগের সৃষ্টি হয়েছিল কিনা বা এ যুগের কোন সাহিত্য পাওয়া যায় কিনা? বখতিয়ার খিলজী এদেশে আসেন ১২০৪ সালে আর মূলত মুসলমানগণ এদেশে আসতে শুরু করে অষ্টম শতাব্দী থেকেই। ইসলাম প্রচারকগণ ইসলাম প্রচারের জন্য আর আরব বণিকগণ ব্যবসার উদ্দেশ্যে এদেশে আসে। এদেশে নিম্নবর্গীয় হিন্দু এবং নির্যাতিত বৌদ্ধ ইসলামের সুমহান আদর্শ দেখে তখন থেকেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়া শুরু করে। বখতিয়ার যখন এদেশে আসে তখন কোন যুদ্ধ করতে হয়নি। মুসলিম সেনা রাজ্যে প্রবেশ করেছে এ খবর শুনে লক্ষণ সেন পিছনের দরজা দিয়ে একা পালিয়ে যায়। বখতিয়ার খিলজী মাত্র ১৭ জন সাথী নিয়ে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন। কোনরূপ সংঘর্ষ বা রক্তপাত হয়নি। বখতিয়ার এসে কাউকে রাজ্য থেকে বের করেও দেয়নি বরং মুসলমানগণ এদেশে মাতৃভাষার চর্চার ব্যপারে উৎসাহ দেয় এবং কবি সাহিত্যিকদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। যার প্রমাণ লক্ষণ সেনের সভাকবি জয়দেব এবং হলয়ুদ মিশ্রকে বখতিয়ার তাঁর সভাকবি হিসেবে রেখে দেন এবং ১২০১-১৩৫০ খ্রি এর মধ্যে যে সমস্ত সাহিত্যকর্ম রচিত হয় তার মাঝে উল্লেখযোগ্য রামাই পণ্ডিতের “শূন্য পুরাণ”, জয়দেবের শ্রেষ্ঠ কীর্তি “গীতগোবিন্দ” এবং মুসলমানদের শাসকদের প্রশংসা কীর্তন গেয়ে হলয়ুদ মিশ্র “শেখ শুভদোয়া” কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন।


প্রকৃতপক্ষে মুসলিম শাসনামলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নবজন্ম ঘটে। মুসলিম আমলের পূর্বে বাংলা সাহিত্যের শুধুমাত্র চর্যাপদ ছাড়া অন্য কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। ড. সুনীতিকুমার ও সুকুমার সেনরা সত্য আড়াল করেছে কিন্তু ড. দীনেশ চন্দ্র কিছুটা ইতস্তত করেও স্বীকার করেছে যে ‘হিন্দু নৃপতিগণ নয়, মুসলমান সুলতানগণই মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্চায় উৎসাহ প্রদান করেছেন (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য- পৃঃ ৭৩)। ড. ওয়াকিল আহমেদ বলেন- “বাংলা সাহিত্যে কথিত ‘অন্ধকার যুগ’ মোটেই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের যুগ ছিল না। ধর্ম-শিক্ষা শিল্প চর্চার দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত ছিল, তারা সীমিত আকারে হলেও শিক্ষা সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন।“ (বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্ত, পৃ-১০৫)। বিশিষ্ট গবেষক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান “বাংলার সামাজিক ও সংস্কৃতির ইতিহাস” গ্রন্থের ভূমিকায় বলেন “যদি বাংলায় মুসলিম বিজয় ত্বরান্বিত না হতো এবং এদেশে আরো কয়েক শতকের জন্য হিন্দু শাসন অব্যাহত থাকতো, তবে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেত এবং অবহেলিত ও বিস্মৃত-প্রায় হয়ে অতীতের গর্ভে নিমজ্জিত হতো।“


মুসলিম শাসনামলে বাংলা সাহিত্যে নবপ্রাণ সঞ্চারিত হয়। এ যুগে মৌলিক সাহিত্য ও অনুবাদ সাহিত্য উভয় শাখায় কাজ হয়। মৌলিক সাহিত্যের মাঝে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, পুথি সাহিত্য, লোকসাহিত্য, জঙ্গনামা সাহিত্য, মার্সিয়া সাহিত্য, কবিগান, নাথ সাহিত্য প্রভৃতি রচিত হয়। অনুবাদ সাহিত্যে মুসলিম সুলতানগণের আদেশে সংস্কৃত থেকে রামায়ণ, মহাভারত, ভগবত বাংলায় অনুবাদ হয় এবং আরবী ও ফার্সী সাহিত্য থেকে মুসলমান কবিগণ অসংখ্য রোমান্টিক প্রণয় উপাখ্যান বাংলায় অনুবাদ করেন।

মধ্যযুগীয় সাহিত্যে হিন্দু কবিদের কাব্যে তাদের ধর্ম, দেব-দেবী ও পৌরাণিক কাহিনীতে ভরপুর। মানবিক আবেদন সেখানে ছিল না বললেই চলে।অবশ্য রাধা-কৃষ্ণের পরকীয়া প্রেম, ষোল শো গোপিনীর সাথে শ্রীকৃষ্ণের অবৈধ প্রণয়লীলা, মঙ্গলকাব্য ও অন্যান্য সাহিত্যের অসংখ্য কাহিনিতে অশ্লীলতা, নগ্নতা, ব্যভিচার ও অনৈতিকতা কিছু মানবীয় কাহিনী এতো প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে যে কোন রুচিশীল পাঠকই তা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। আর বৈষ্ণব সাহিত্য, মঙ্গলকাব্যে সব একি কাহিনী বারবার আলোচনা হতে হতে একটা চরম বিরক্তিকর একঘেয়েমিতে ভরে উঠেছিলো মধ্যযুগীয় সাহিত্য ঠিক এমনি সময়ে মুসলমান কবি-সাহিত্যিকগণ কুরআন-হাদীস, নবী-রাসূল, ইসলামের ইতিহাস ও মানবিক ইসলামি ভাব-সম্পদ তো আছেই উপরন্তু মানবিক সংবেদনা, প্রেম-প্রণয়, জীবনের আর্তি মানবিক রসে জারিত করে হৃদয়গ্রাহীভাবে সাহিত্য ফুটিয়ে তুলেছেন। এ প্রসঙ্গে ড. আহমদ শরীফ তাঁর “বাঙালী ও বাংলা সাহিত্য”, ড এম এ রহীম তাঁর “বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস”, নাজিরুল ইসলাম তাঁর “বাংলা সাহিত্যের নতুন ইতিহাস”, প্রভৃতি গ্রন্থে নিজস্ব ভাষায় বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। মধ্যযুগের উল্লেখযোগ্য মুসলিম কবি হলেন- শাহ মোহাম্মদ সগীর, আব্দুল হাকীম, ফকীর গরীবুল্লাহ, ফকীর মুহাম্মদ, দৌলত উজির, বাহরাম খাঁ, শেখ ফয়জুল্লাহ, আলাউল, মাগন ঠাকুর, মুহাম্মদ কবির প্রভৃতি।


মধ্যযুগীয় কাব্যসাহিত্যে পয়ার ছন্দের ব্যবহার সব কবিরাই করেছেন এবং ভাষা, বিষয়বস্তু, ভাবানুভূতি বা অনুপ্রেরণা, আঙ্গিক ও প্রকরণগত বিভিন্ন দিকে আমাদের সাহিত্য একটি প্রাণময়, দীপ্তিময়, ঐশ্বর্যমণ্ডিত ধারা গড়ে উঠেছে তা মূলত আরবী-ফারসী সাহিত্য প্রভাবিত হয়ে। আরবী ভাষায় আল্লাহ তায়ালার নাযিলকৃত মহাগ্রন্থ আল-কুরআন কেবল মানব জাতির জীবন বিধানই নয়, এর শব্দ বিন্যাস, বাক্য গঠন প্রণালী, তাৎপর্যপূর্ণ প্রয়োগ-বিধি, উপমা, ছন্দ, বিশিষ্টাত্মক শব্দ, অর্থ, লালিত্য ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে এক অনন্য গ্রন্থ। যেহেতু এটি বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহর সৃষ্টি তাই এর রুপ-সৌন্দর্য ও অন্যান্য বৈশিষ্ট পৃথিবীর অন্য কোন গ্রন্থের সাথে তুলনা করাও ধৃষ্টতা মাত্র। আর মুসলমানগণ ইসলাম প্রচার, রাজ্য জয়, ব্যবসা-বাণিজ্য বা যে উদ্দেশ্যেই পৃথিবীর যে কোন দেশে গেছে, সেখানেই এই গ্রন্থটি সাথে নিয়ে গেছে, ফলে সেখানকার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনাচারের উপর এ গ্রন্থের অনিবার্য প্রভাব অবশ্যই কম-বেশি পড়েছে। আল-কুরআনের সাথে সাথে আরবি, ফার্সি, তুর্কি, উর্দু প্রভৃতি ভাষার বিশ্ববরেণ্য অসংখ্য কবি ও তাদের অমর সাহিত্যের প্রভাবও বাংলা সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে ও বাংলা সাহিত্য তার আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক ভাবধারা ও ঐশ্বর্য-সম্পদে সুসমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন